বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত শতাধিক নারীর বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় হলেও কারোর রায়ই কার্যকর হয়নি। এমনকি গাজীপুরের কাশিমপুরে থাকা একমাত্র নারী কারাগারেও নেই কোনো ফাঁসির মঞ্চ। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার পর তাঁর ফাঁসি কার্যকরের বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে।
গত রবিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে প্রোসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাবে বলেন, সিআরপিসিতে জামিন প্রদানের ক্ষেত্রে নারী, অসুস্থ, কিশোর, বালক, শিশুদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। কিন্তু রায় দেওয়ার ক্ষেত্রে নারীকে সাধারণ আইনেও কোনো আলাদা প্রিভিলেজ দেওয়া হয় না। ট্রাইব্যুনাল আইনেও কোনো আলাদা প্রিভিলেজ নেই। অতএব, রায় প্রদানের ক্ষেত্রে আসামি নারী হোক বা পুরুষ হোক—তিনি তাঁর অবস্থানে থেকে কী অপরাধ করেছেন, সেই অপরাধের গ্র্যাভিটি বিবেচনা করে শাস্তি প্রদান করা হবে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত। এর আগে মামলার পঞ্চম ও শেষ দিনের যুক্তিতর্ক শেষে শেখ হাসিনাকে আইনে বর্ণিত সর্বোচ্চ সাজা (মৃত্যুদণ্ড) দিতে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রতি আরজি জানান চিফ প্রোসিকিউটর তাজুল ইসলাম। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল সোমবার মামলার রায়ে শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়।
এদিকে কারা সূত্র জানায়, বাংলাদেশের ইতিহাসে আজ অবধি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কোনো নারী আসামির ফাঁসি কার্যকর হয়নি। দেশের একমাত্র নারী কারাগারেও ফাঁসির কোনো মঞ্চ নেই। কারাগারটির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তৎকালীন সাবেক আইজি প্রিজন্স ব্রিগেডিয়ার জাকির হাসানের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি জানিয়েছিলেন, অতীতে কোনো নারী আসামির ফাঁসি কার্যকর হয়নি বলে রাখা হয়নি ফাঁসির মঞ্চ।
এক হিসাবে দেখা গেছে, স্বাধীনতার পর থেকে শতাধিক নারীর ফাঁসির আদেশ হয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো নারীর ফাঁসি কার্যকর হয়নি। তাঁদের মধ্যে অনেকেই দীর্ঘদিন কারাভোগ করার পর মুক্তি পেয়েছেন, কেউ মারা গেছেন, কারো আপিলে শাস্তি কমেছে। কারা অধিদপ্তরের সহকারী কারা মহাপরিদর্শক মো. জান্নাত-উল ফরহাদ গণমাধ্যমকে জানান, সারা দেশের কারাগারগুলোতে বর্তমানে ফাঁসির আসামি হিসেবে ৯৪ জন নারী বন্দি রয়েছেন। এর মধ্যে কাশিমপুর কারাগারে রয়েছেন ৩৪ জন।
গতকাল শেখ হাসিনার ফাঁসির রায়ের আগ পর্যন্ত সর্বশেষ ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ছিলেন বরগুনার স্বামী রিফাত শরিফ হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি। বর্তমানে কাশিমপুর মহিলা কারাগারের মাধবীলতা সেলে বন্দি আছেন তিনি। ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর মিন্নির ফাঁসির রায় হলেও পাঁচ বছরেও কার্যকর হয়নি তাঁর ফাঁসি। এ ছাড়া ফাঁসির আসামি হিসেবে বন্দি রয়েছেন ২০১৯ সালের আলোচিত ফেনীর সোনাগাজী মাদরাসাছাত্রী নুসরাত হত্যা মামলার ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি কামরুন্নাহার মণি ও উম্মে সুলতানা পপি, ইডেন কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মাহফুজা চৌধুরী হত্যা মামলার আসামি গৃহকর্মী রীতা আক্তার ও রুমা ওরফে রেশমা, মা–বাবাকে হত্যার দায়ে ফাঁসির রায় পাওয়া ঐশী রহমানসহ আরও অনেকে। তাঁদের অনেকের মামলা হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স হিসেবে শুনানিতে রয়েছে। আবার অনেকে ডেথ রেফারেন্স নিয়ে আপিল করেছেন, সেগুলো আপিল বিভাগে বিচারাধীন। দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের বেশির ভাগই পরিবারের সদস্যদের হত্যার দায়ে দণ্ডিত। তবে আইনি প্রক্রিয়ার জটিলতা এবং উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তের কারণে তাঁদের ফাঁসি কার্যকর হয়নি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ফাঁসির ক্ষেত্রে নারীদের আইনত কোনো বাধা নেই। বাংলাদেশে নারীদের ফাঁসি কার্যকর না হওয়ার মূল কারণ হলো—উচ্চ আদালতের শাস্তি হ্রাসের প্রবণতা, আইনি বিধানে বিশেষ বিবেচনা, রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা আবেদন না পৌঁছানো, ফাঁসির মঞ্চের অভাব এবং সামাজিক–সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি। এসব কারণ একত্রে নারীদের ফাঁসির রায় কার্যকরে বাধা সৃষ্টি করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আরিফ জামিল গণমাধ্যমকে বলেন, শেখ হাসিনার এই মামলা অন্য নারীদের মামলা থেকে ভিন্ন। এটি একটি আন্তর্জাতিক অপরাধের রায়। একই সঙ্গে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি নিজেও পলাতক। সে ক্ষেত্রে তিনি আদৌ দেশে ফিরবেন কি না বা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে কি না, সে প্রশ্ন থেকে যায়। তাঁর রায় কার্যকর হবে কি না, কবে নাগাদ হবে—সেটা এখনই বলা যায় না। নারী হিসেবে তিনি সিম্প্যাথি দাবি করতে পারেন, কিন্তু সেই সিম্প্যাথি তাঁকে দেওয়া হবে কি না সেটাও অনিশ্চিত। তাই তাঁর বিষয়টি এখনই কোনো সিদ্ধান্তে আসার মতো নয়। তবে যেহেতু তাঁর অপরাধ ও প্রেক্ষাপট ভিন্ন, সেহেতু নারী হলেও তাঁর ফাঁসি প্রথমবারের মতো কার্যকর হলে তা অবাক করার মতো হবে না।



