Image description

ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার তৈরি শান্তি প্রস্তাবকে অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য বলে প্রত্যাখ্যান করেছে কিয়েভ। বিষয়টি উঠে এসেছে প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ও যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের সামরিক প্রতিনিধিদলের বৈঠকের প্রেক্ষাপটে।

ইউক্রেনের কর্মকর্তারা বলছেন, ভ্লাদিমির পুতিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী কিরিল দিমিত্রিয়েভ ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফের তৈরি এই পরিকল্পনা মূলত একধরনের ‘উসকানি’, যার লক্ষ্য ইউক্রেনের মিত্রদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করা এবং পরিস্থিতি ঘোলাটে করে দেওয়া।

ইউক্রেনের সংসদের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির প্রধান অলেক্সান্দর মেরেজকো বলেন, ‘আলোচনায় বসার মতো কোনো ইঙ্গিত এখনও ক্রেমলিন দেখায়নি। পুতিন সময় নষ্ট করছেন এবং মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এড়াতে চাইছেন।’ দিমিত্রিয়েভকে তিনি ‘অখ্যাত ব্যক্তি’ বলে উড়িয়ে দেন।

ইউক্রেনের প্রথম উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই কিসলিৎসিয়া উদ্যোগটিকে অবাস্তব বলে মন্তব্য করেন। তার মতে, এটি মতামত প্রভাবিত ও আতঙ্ক সৃষ্টির একটি ক্লাসিক সোভিয়েত-স্টাইল ‘তথ্য অপারেশন’।

নতুন প্রস্তাবে কী রয়েছে

ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২৮ দফার এই প্রস্তাবে ২০২২ সালে রাশিয়ার পূর্ণমাত্রায় আগ্রাসনের পর ক্রেমলিন যেসব দাবি তুলেছিল, তার সঙ্গে বেশ মিল রয়েছে। এটি নাকি রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা তৈরি করেছেন ট্রাম্পের সমর্থনে। ইউক্রেনকে এতে কোনোভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এক ইউরোপীয় কূটনীতিক বলেন, তারা (ইউক্রেন) সংবাদে চোখ না দেওয়া পর্যন্ত প্রস্তাবটি সম্পর্কে কিছুই জানত না।

পরিকল্পনা অনুযায়ী, ইউক্রেনকে দনবাস অঞ্চলের উত্তরাংশ, যা বর্তমানে তাদের নিয়ন্ত্রণে, রাশিয়ার হাতে তুলে দিতে হবে। তাদের সেনাবাহিনী অর্ধেকে নামিয়ে আনতে হবে। ইউক্রেনকে তার দূরপাল্লার অস্ত্রও ছাড়তে হবে, যেগুলো রাশিয়ার অভ্যন্তরে সামরিক স্থাপনায় হামলার জন্য ব্যবহার করা হয়।

ইউক্রেনের মাটিতে কোনো বিদেশি সেনা মোতায়েন করা যাবে না; এতে যুক্তরাজ্য-ফ্রান্স নেতৃত্বাধীন সম্ভাব্য শান্তিরক্ষী বাহিনীর ব্যবস্থাও বাতিল হয়ে যায়। তবে যুক্তরাষ্ট্র নাকি ইউক্রেনকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেবে, এমন দাবি করেছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম অ্যাক্সিওস।

পরিকল্পনায় রুশ ভাষা ও রুশ অর্থডক্স চার্চকে আনুষ্ঠানিক মর্যাদা দেওয়ার কথাও আছে, যা দীর্ঘদিন ধরে ক্রেমলিনের দাবি।

ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা বলছেন, এই দলিল কার্যত ইউক্রেনের আত্মসমর্পণের সমান এবং সার্বভৌমত্বের সমাপ্তি। প্রায় চার বছর আগে রুশ বাহিনী কিয়েভ দখলে ব্যর্থ হওয়ার পর এখন এমন একটি প্রস্তাব সামনে এসেছে, যখন ট্রাম্প প্রশাসনের শান্তি প্রচেষ্টাও স্থবির।

জেলেনস্কি-যুক্তরাষ্ট্র বৈঠক

প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি যুক্তরাষ্ট্রের আর্মি সেক্রেটারি ড্যান ড্রিসকলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। ট্রাম্প তাকে গত সপ্তাহে ‘বিশেষ প্রতিনিধি’ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। ড্রিসকল যুদ্ধ পরিস্থিতি এবং ইউক্রেনের ড্রোন উৎপাদন নিয়ে খোঁজখবর নিতে কিয়েভে আছেন। বৈঠকে মার্কিন পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়েছে কি না তা পরিষ্কার নয়।

এদিকে ট্রাম্পের আরেক বিশেষ প্রতিনিধি কিথ কেলগ জানুয়ারিতে পদত্যাগ করছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। তিনি ইউক্রেন-সমর্থক হিসেবে পরিচিত। তবে এবার তাকে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

কিয়েভে রাজনৈতিক সংকটের সময় নতুন চাপ

হোয়াইট হাউসের নতুন চাপ এমন সময়ে এসেছে, যখন জেলেনস্কি ২০১৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক কেলেঙ্কারির মুখে পড়েছেন। তার সাবেক ব্যবসায়িক অংশীদার তিমুর মিনদিচ ও দুজন মন্ত্রী বড় ঘুষ কেলেঙ্কারিতে জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। জেলেনস্কির নিজ দলের কয়েকজন সংসদ সদস্য তার শক্তিশালী চিফ অব স্টাফ আন্দ্রি ইয়েরমাককে বরখাস্ত করার দাবিও তুলেছেন।

এক পশ্চিমা কূটনীতিক বলেছেন, রাশিয়া ইউক্রেনের অভ্যন্তরীণ সংকটের সুযোগ নিতে চাইছে। তিনি বলেন, ‘দিমিত্রিয়েভ এমন সময় এই পরিকল্পনা সামনে এনেছেন, যখন জেলেনস্কি দুর্বল। রাশিয়ানরা এ ধরনের সুযোগ কাজে লাগাতে ওস্তাদ। এটি আগের মতোই একটি রুশ পরিকল্পনা মনে হচ্ছে। কিন্তু ইউক্রেন এটি গ্রহণ করবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘রুশ ভাষা নিয়ে ক্রেমলিনের দাবি ‘একটি ফাঁদ’, যা পরে কাজে লাগানো হবে। প্রস্তাবে ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মতো কোনো প্রকৃত নিশ্চয়তাও নেই। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ থেকে এমন নিশ্চয়তা পাওয়া দরকার।’

ইউরোপের প্রতিক্রিয়া

ব্রাসেলসের বৈঠকে অংশ নেওয়া ইউরোপীয় নেতারা জানান, তাদের আগে কিছুই জানানো হয়নি। তারা মনে করিয়ে দেন, ট্রাম্প প্রশাসন ইতোমধ্যে ইউক্রেনে সরাসরি সামরিক সহায়তা বন্ধ রেখেছে; যা মস্কোপন্থী শান্তিচুক্তি চাপিয়ে দেওয়ার ক্ষমতাও কমিয়ে দিয়েছে।

পোল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাদোসোয়াফ সিকোরস্কি বলেন, ‘আমরা শান্তি প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানাই, কিন্তু ইউক্রেনের প্রধান সমর্থক ইউরোপ। আমাদের নিরাপত্তাই এখানে মূল বিষয়। তাই বিষয়টি নিয়ে আমাদের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত ছিল।’

ইইউ’র পররাষ্ট্রবিষয়ক প্রধান কায়া কালাস বলেন, ‘যেকোনো স্থায়ী ও ন্যায্য সমাধানের জন্য অবশ্যই ইউক্রেন ও ইউরোপের সমর্থন লাগবে। দিমিত্রিয়েভ-উইটকফ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করতে চাইলে রাশিয়াকে কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের বুঝতে হবে, এই যুদ্ধে একজন হামলাকারী আর একজন ভুক্তভোগী। রাশিয়া যদি সত্যিই শান্তি চাইত, তবে অনেক আগেই নিঃশর্ত যুদ্ধবিরতিতে রাজি হতে পারত।’

এদিকে ব্রিটিশ সরকার ট্রাম্পের যুদ্ধ বন্ধের ইচ্ছাকে স্বাগত জানালেও বলেছে, ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের অধিকার শুধু ইউক্রেনীয় জনগণের। তারা আবারও বলেছে, রাশিয়া যদি চায়, আগামীকালই সৈন্য প্রত্যাহার করে যুদ্ধ বন্ধ করতে পারে।

ওয়াশিংটনের অবস্থান ও সাম্প্রতিক আক্রমণ

হোয়াইট হাউসের ডেপুটি চিফ অব স্টাফ স্টিফেন মিলার প্রস্তাব নিয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। তবে তিনি বলেন, ‘ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের সমাধান করে ইউরোপে শান্তি প্রতিষ্ঠা করাই আমাদের পররাষ্ট্রনীতির প্রধান লক্ষ্য।’

আগস্টে আলাস্কায় ট্রাম্প-পুতিন বৈঠকের পর যুক্তরাষ্ট্র শান্তি প্রচেষ্টায় বিভিন্ন বাধার মুখে পড়ে। এরপর ট্রাম্প রাশিয়ার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন পুতিনকে আলোচনায় বসানোর উদ্দেশ্যে। পরে তিনি জানান, বুদাপেস্টে পুতিনের সঙ্গে বৈঠকটি স্থগিত করছেন; কারণ এতে কোনো কাজ হবে না।

এদিকে বুধবার আঙ্কারায় জেলেনস্কি ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বৈঠক করে শান্তিপূর্ণ সমাধানের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন।

রাশিয়া সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ইউক্রেনের জ্বালানি অবকাঠামোর ওপর হামলা বাড়িয়েছে, ফলে দেশের বড় অংশ অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে। বুধবার রাশিয়া পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি শহরে হামলা চালায়। তেরনোপিলে একটি বোমা হামলায় ২৬ জন নিহত হয়, যার মধ্যে তিন শিশুও ছিল।