জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও এর ঐতিহ্যের সূচনা ১৮৫৮ সালে, যখন ঢাকার সমাজসেবক কিশোরলাল রায় চৌধুরী তাঁর দাদা জগন্নাথ রায় চৌধুরীর স্মৃতিতে পুরান ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘জগন্নাথ স্কুল’। পরবর্তীতে ১৮৭১ সালে এটি উন্নীত হয় জগন্নাথ কলেজে, যা উনিশ শতকের শেষভাগে পূর্ববঙ্গের অন্যতম প্রধান উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে।
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময়ও জগন্নাথ কলেজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে—এর শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও পাঠ্যধারা নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তি গঠনে সহায়তা করে। ১৯৬৮ সালে কলেজটি জাতীয়করণ হয় এবং ২০০৫ সালে এটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়।
তবে ‘জগাবাবুর পাঠশালা’ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হওয়ার প্রায় দুই দশক পেরিয়ে গেলেও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এখনো নানা অভাব-অভিযোগ ও অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে চলছে। সবচেয়ে ভয়াবহ সংকটটি হলো আবাসন সংকট।
বর্তমানে প্রায় ২০ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য মাত্র ১,৯০০টি আবাসন সিট রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৭০০টি সিট আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের মুসলিম মিশনারি ছাত্রাবাস প্রকল্পের আওতায়, যেখানে সিটের নিশ্চয়তা নেই এবং কঠোর নিয়মের কারণে শিক্ষার্থীদের যেকোনো সময় সিট বাতিলের আশঙ্কা থাকে। অন্যদিকে প্রায় ১২ হাজার ছাত্রীদের জন্য রয়েছে মাত্র একটি ছাত্রী হল, যা চাহিদার তুলনায় অতি অপ্রতুল।
জগন্নাথ কলেজ থাকাকালীন সময়ের ছাত্রাবাস ও ছাত্রীনিবাসগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের পর বেদখলে চলে যায়। সেই থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়টি আবাসন সংকটে জর্জরিত। শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক আন্দোলনের ফলে একটি ছাত্রী হল, একটি সমাজসেবামূলক সংস্থার প্রকল্পে কিছু সিট, দুটি অস্থায়ী হল এবং আবাসন ভাতা চালু হলেও এগুলোর কোনোটিই দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নয়।
জবি শিক্ষার্থীরা বলেন, যেখানে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্যারিয়ার গঠনে মনোযোগী, সেখানে তারা প্রতিদিন টিকে থাকার লড়াই করছেন। পুরান ঢাকায় বাসা পাওয়া, ভাড়া দেওয়া, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা—এসবই প্রতিদিনের সংগ্রাম।
ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী শাহিন মিয়া বলেন, “পুরান ঢাকায় ভাড়া বাসায় থাকা ব্যয়বহুল ও অনিরাপদ। প্রতিদিন যাতায়াতের চাপেও পড়াশোনায় মনোযোগ দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।”
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী কাজী আহাদ বলেন, “অস্থায়ী হলে নিরাপত্তা নেই, আবার আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের নিয়মে যেকোনো সময় সিট বাতিল হতে পারে। স্থায়ী সমাধান ছাড়া শিক্ষার্থীরা অনিশ্চয়তায় থাকবে।”
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জবির এই সমস্যার একমাত্র টেকসই সমাধান হলো দ্বিতীয় ক্যাম্পাসে স্থায়ী হল ও ডরমিটরি নির্মাণ। এর সঙ্গে প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো—রাস্তা, মসজিদ, মন্দির, মেডিকেল সেন্টার, লাইব্রেরি, ক্যাফেটেরিয়া, স্পোর্টস সেন্টার ও নিরাপত্তা ফাঁড়ি ইত্যাদি।
কারণ, যেকোনো সময় আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন তাদের বরাদ্দকৃত সিট বাতিল করতে পারে, সরকার আবাসন ভাতা বন্ধ করতে পারে এবং অস্থায়ী হলগুলোও ঝুঁকিপূর্ণ ও অনিরাপদ। ফলে এখনই স্থায়ী সমাধান না হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ, সংস্কৃতি এবং শিক্ষার্থীদের মানসিক নিরাপত্তা—সবকিছুই হুমকির মুখে পড়বে।
দেড় শতাধিক বছরের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আজও পুরান ঢাকার কেন্দ্রবিন্দুতে জ্ঞানচর্চার প্রতীক হয়ে আছে। তবে অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা ও আবাসন সংকট সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে এই ঐতিহ্য ধরে রাখা এবং শিক্ষার মান অক্ষুণ্ণ রাখা ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
                                
                                


