Image description

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় এবং তার পরপরই আগস্ট মাসে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডসহ কিছু অপরাধের বিচার হবে, আবার কোনোটির বিচার চাওয়া যাবে না– এরকম পরিস্থিতি তৈরির শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে ঘোষিত 'জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫' এর অঙ্গীকারনামায় ২০২৪ সালের জুলাই- আগস্টে গণ-অভ্যুত্থানকালে সংঘটিত 'হত্যাকাণ্ডের বিচার', অন্যদিকে 'আইনগত দায়মুক্তির' বিষয়টি একই সাথে রাখা হয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে আলোচনা তৈরি হয়েছে এবং এটি ভবিষ্যতে দেশে নতুন সংকটের জন্ম দিতে পারে বলেও শঙ্কা রয়েছে।

এর আগেও বাংলাদেশে হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনায় দায়মুক্তি দেওয়া এবং পরে সেই দায়মুক্তি যাদের দেওয়া হয়েছিলো তাদের বিচারের মুখোমুখি হওয়ার উদাহরণ আছে।

বিশ্লেষকরা কেউ বলছেন, কারও কোনো পদক্ষেপ অপরাধ হিসেবে প্রমাণিত হলে তার শাস্তি সবার জন্যই এক হওয়া উচিত। আবার কেউ বলছেন, বিচার চাওয়ার অধিকার থেকে কাউকে বঞ্চিত করা আইনসম্মত নয়।

জুলাই সনদে ঢালাও দায়মুক্তির সুযোগ রাখা ভবিষ্যতে সনদটিকেই বিতর্কে ফেলে দিতে পারে, মনে করছেন তাদের অনেকে।

শুক্রবার স্বাক্ষরিত জুলাই সনদে 'শহীদ পরিবার' ও 'আহত বীর যোদ্ধাদের' আইনগত দায়মুক্তি, মৌলিক অধিকার সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার ব্যক্ত হলেও কারা কী ধরনের অপরাধ বা কর্মকাণ্ডের জন্য দায়মুক্তি পাবেন তা নিয়ে বিস্তারিত কিছু বলা হয়নি।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের একজন সদস্য অবশ্য জানিয়েছেন, জুলাই সনদ একটি জাতীয় অঙ্গীকার, যার কিছু বিষয় বর্তমান সরকারই বাস্তবায়ন করবে।

"এরপর আগামী জাতীয় সংসদ ও ওই সংসদের মাধ্যমে গঠিত সরকারই 'জুলাই গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিটকে' বিবেচনায় নিয়ে সনদের কোন অংশ কীভাবে বাস্তবায়ন হবে তা নির্ধারণ করবে"।

প্রসঙ্গত, অন্তর্বর্তী সরকার এর আগে ২০২৪ সালের অক্টোবরেই গণঅভ্যুত্থান সংশ্লিষ্ট ঘটনার জন্য এর পক্ষে যারা ছিল তাদের কোনো মামলা, গ্রেফতার বা হয়রানি করা হবে না- মর্মে জানিয়েছিলো। কিন্তু শুক্রবার সরকার ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের স্বাক্ষরের জন্য তৈরি করা সনদে প্রথমে 'দায়মুক্তি' প্রসঙ্গটি রাখা হয়নি।

পরে 'জুলাই শহীদ পরিবার ও আহত যোদ্ধা' ব্যানারে কয়েকশ মানুষ সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের মূল মঞ্চের সামনে বিক্ষোভ করে জুলাই সনদ সংশোধন, সনদকে স্থায়ীভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত এবং 'জুলাই যোদ্ধা'দের স্বীকৃতি- এই তিন দফা দাবি জানান।

তারা পুলিশে সঙ্গে সংঘর্ষেও জড়িয়ে পড়েন। এরপর ঐকমত্য কমিশন ও সরকারের দিক থেকে জুলাই সনদের অঙ্গীকারনামায় সংশোধনী এনে 'দায়মুক্তির' বিষয়টি সংযোজন করা হয়।

প্রসঙ্গত, গত বছর জুলাই অভ্যুত্থানে ৮৪৪ জন নিহত হয়েছে বলে সরকারি হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং গেজেট প্রকাশ করে যাদেরকে 'শহীদ' হিসেবে স্বীকৃতিও দেওয়া হয়েছে। তবে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী জুলাই-আগস্টে নিহতের সংখ্যা বলা হয়ে প্রায় ১৪০০ জন।

আন্দোলন চলাকালে বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় হামলা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে, আবার হত্যাকাণ্ডও সংঘটিত হয়েছে।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী, অন্তত ৪৪ জন পুলিশ সদস্য হত্যার শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় হামলা করে ১৫ জন পুলিশকে হত্যা করা হয়েছে, আবার যাত্রাবাড়ীতে আন্দোলন চলার সময় দুইজন পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে লাশ ঝুলিয়ে রাখার মতো ঘটনাও ঘটেছে।

পাঁচই আগস্ট থেকে পরের কয়েকদিন আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট অনেকের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনার অভিযোগ রয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকার আন্দোলনকারীদের হত্যা-নির্যাতনের মতো ঘটনায় বিচার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। কিন্তু সেই জুলাই-অগাস্টে আন্দোলনকারীদের মধ্য থেকে যারা সহিংসতায় জড়িত ছিলেন, তাদের বিচারের বাইরে রাখা হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে।

পুলিশ হত্যাসহ আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বিভিন্ন স্থানে হত্যাকাণ্ডের বিচার ঘিরে এখনো প্রশ্ন রয়ে গেছে।

ভবিষ্যতে কোনো সরকার এসে এসব ঘটনার বিচার কার্যক্রম করবে কি না– সেই আশঙ্কা থেকে আন্দোলনে যুক্তদের পক্ষ থেকে সংবিধানে বারবার আইনগত 'দায়মুক্তির' প্রসঙ্গটি তোলা হয়েছে। জুলাই ঘোষণাপত্রেও এই বিষয়টি আসে। সর্বশেষ জুলাই সনদ স্বাক্ষরের আগে শেষমুহূর্তে আন্দোলনকারীদের দাবির মুখে এটি সনদে সংযোজন করা হয়।

বিভিন্ন সময়ে দেওয়া দায়মুক্তি

লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম দায়মুক্তি দেওয়ার ঘটনা ঘটেছিলো ১৯৭২ সালে। তখন একাত্তরের ২৫শে মার্চ থেকে বাহাত্তরের ৩০শে জানুয়ারি পর্যন্ত সংঘটিত ঘটনার দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছিলো।

মূলত ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দেশীয় সহযোগীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় সংঘটিত ঘটনাগুলোর দায় থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সুরক্ষার জন্য তখন এই দায়মুক্তি দেওয়ার কথা বলা হয়েছিলো।

এ নিয়ে কখনো কোনো রাজনৈতিক বা আইনি বিতর্কও জোরালো হতে দেখা যায়নি।

তবে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক বিতর্ক হয়েছে পঁচাত্তরের ১৫ই অগাস্টে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের পর ওই বছরের সেপ্টেম্বরে জারি করা 'ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ' নিয়ে।

খন্দকার মোশতাক আহমেদের সরকারে ওই অধ্যাদেশ পরে ১৯৯৬ সালে বাতিল করা হয়। পরবর্তীতে ওই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতদের মধ্যে ছয়জনের বিচার ও শাস্তি কার্যকর করা হয়েছিল।

এছাড়া ১৯৭৪ সালে রক্ষী বাহিনীকেও তাদের কর্মকাণ্ড থেকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। আবার বিএনপি আমলে ২০০২ সালের ১৬ই অক্টোবর থেকে ২০০৩ সালের নয়ই জানুয়ারি পর্যন্ত যৌথ বাহিনী অপারেশন ক্লিনহার্ট পরিচালনা করে।

সেই অভিযানে নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে অন্তত ৪০ জনের মৃত্যুর অভিযোগ ওঠে। অভিযানে অংশগ্রহণকারীদের দায়মুক্তি দিয়ে ২০০৩ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে যৌথ অভিযান দায়মুক্তি আইন পাস হয়।

পরে অবশ্য একটি রিট আবেদনের পর ২০১৫ সালে সেই আইন অবৈধ ঘোষণা করেছিলো হাইকোর্ট।

সবশেষ শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ২০২৪ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছিলো "গণ-অভ্যুত্থানকে সফল করতে যেসব ছাত্র-জনতা সক্রিয়ভাবে আন্দোলনের মাঠে থেকে এর পক্ষে কাজ করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে ১৫ই জুলাই থেকে আটই অগাস্ট পর্যন্ত সংগঠিত গণঅভ্যুত্থান সংশ্লিষ্ট ঘটনার জন্য কোনো মামলা, গ্রেফতার বা হয়রানি করা হবে না"।

তবে তখনও, কীভাবে আন্দোলনের পক্ষে কাজ করেছেন– তা নির্ধারিত হবে কীভাবে বা কারা কোন অপরাধে দায়মুক্তি পাবে তা বিস্তারিত বলা হয়নি।

এ ধরনের দায়মুক্তির প্রয়োজন হলো কেন এবং কারা দায়মুক্তি পাবে– এমন প্রশ্নের জবাবে অন্তর্বর্তী সরকারের যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া তখন বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, "গণআন্দোলনে যারা অংশ নিয়েছে তাদের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য হবে যাতে তারা কোনো হয়রানির শিকার না হয়"।

সনদে কী ছিল আর কী পরিবর্তন আনা হয়েছে

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে শুক্রবার রাতেই বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়, যার শিরোনাম ছিল 'জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ বাস্তবায়নের অঙ্গীকারনামা এর দফা (৫) এর সংশোধনী'।

এতে বলা হয়- "গণঅভ্যুত্থানপূর্ব বাংলাদেশে ১৬ বছরের আওয়ামী ফ্যাসিবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামে গুম, খুন ও নির্যাতনের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের এবং ২০২৪ সালের জুলাই-অগাস্ট গণঅভ্যুত্থান কালে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় সদস্যের দ্বারা সংঘটিত সব হত্যাকাণ্ডের বিচার, শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান ও শহীদ পরিবারকে এবং জুলাই আহতদের রাষ্ট্রীয় বীর, আহত বীর যোদ্ধাদের যথোপযুক্ত সহায়তা প্রদান যেমন মাসিক ভাতা, সুচিকিৎসা, পুনর্বাসন ব্যবস্থা এবং শহীদ পরিবার ও আহত বীর যোদ্ধাদের আইনগত দায়মুক্তি, মৌলিক অধিকার সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করব"।

এই দফাটিতে আগে ছিল, "গণঅভ্যুত্থানপূর্ব ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামে গুম, খুন ও নির্যাতনের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের এবং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানকালে সংঘটিত সব হত্যাকাণ্ডের বিচার, শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান ও শহীদ পরিবারগুলোকে যথোপযুক্ত সহায়তা প্রদান এবং আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করব"।

বিতর্কের শঙ্কা কেন

বিশ্লেষকরা বলছেন কোনো একটি ঘটনায় ফৌজদারি অপরাধ হয়ে থাকলে তার বিচার বা শাস্তি একেকজনের জন্য একেকরকম হওয়াটা আইনসম্মত নয়, যা ন্যায়বিচারেরও পরিপন্থী।

বরং এভাবে দায়মুক্তির মাধ্যমে ঘটনার যে রাজনীতিকায়ন হয় সেখান থেকে নতুন রাজনৈতিক বিতর্ক বা সংকটের জন্ম হয় বলে তারা মনে করেন।

সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী শাহ্দীন মালিক বলছেন, দায়মুক্তি বিষয়টিই অসাংবিধানিক এবং এর কোনো অবকাশ দেশের সংবিধানে নেই।

"কিসের থেকে দায়মুক্তি দেওয়া হবে তাও স্পষ্ট না। অন্যায়ের শিকার হলে কেউ বিচার চাইতে পারবে না এটি হতে পারে না। আবার কাউকে বিচার পাওয়ার অধিকার চাওয়া থেকে আটকানো যায় না। জুলাই আন্দোলনের বিষয়ে সরকার এভাবে দায়মুক্তির কথা না বলে কৌশলে এর সমাধান করতে পারতো," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

মানবাধিকার সংগঠক নূর খান লিটন বলছেন, অতীতের আলোচিত দায়মুক্তি পরিস্থিতি ও সময়ের বিবেচনায় টেকেনি। বরং যে কোনো দায়মুক্তিই ভবিষ্যতে বিতর্ক উসকে দেয় ও নতুন বিতর্কের জন্ম দেয়।

"এখন যেটা সেটা একপক্ষীয় হয়ে গেলো। এখানে সব দিকেরই ব্যাপার আছে। দায়মুক্তি মানবাধিকারের দৃষ্টিতে দুর্বল। অপরাধ যে পক্ষই করুক তার বিচার হতে হবে। কিন্তু ঢালাও দায়মুক্তি আইনের শাসনের পক্ষে যায় না। দায়মুক্তি না দিয়ে ন্যায্য বিচার জরুরি ছিল। বিচারক নিশ্চয়ই সময়, পরিস্থিতি, প্রেক্ষাপট ও জনপ্রত্যাশার বিষগুলো বিবেচনায় নিতেন। তখন আর বিতর্কের সুযোগ থাকতো না," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, এখানে বিতর্কের কিছু আছে বলে তিনি মনে করেন না।

তিনি বলেন, বাহাত্তরে যেমন হয়েছে তেমনি এখন জুলাই যুদ্ধে যারা জয়ী হয়েছে তারা দায়মুক্তি দাবি করেছে। সেই দাবি তারা করতেই পারে। এতে বিতর্কের কিছু আছে বলে মনে হয় না।

এক প্রশ্নের জবাবে মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, "যে কোনো যুদ্ধে যারা জিতে তারা নিজেদের সুরক্ষা দিতে চাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। নীতিগতভাবে হয়তো বিবেক বা নৈতিকতার প্রশ্ন কেউ তুলতে পারেন, কিন্তু রাজনীতিতে বিবেক সবসময় কাজ করে না"।