দাম্পত্য জীবন শুধু দু’জন মানুষের একসঙ্গে থাকা নয়; এটি দুটি হৃদয়ের মমতায় গড়া এমন এক আশ্রয়, যেখানে প্রত্যেক কষ্টের পর থাকে শান্তির পরশ আর প্রত্যেক ভুলের পর থাকে ক্ষমার দরজা। কিন্তু বাস্তব জীবনে কখনো ভুল–বোঝাবুঝি, রাগ, আবেগ কিংবা শয়তানের কুমন্ত্রণায় সেই মধুর বন্ধন ছিন্ন হয়ে যায়— ঘোর অন্ধকার নেমে আসে স্বামী-স্ত্রীর জীবনে। পরে অনুতাপ, কান্না আর ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় বুক ভেঙে যায়।
কিন্তু সুখবর হলো— ইসলাম সম্পর্ক ছিন্ন করার আগে যেমন সতর্ক করেছে, তেমনি ভাঙা সম্পর্ক জোড়া লাগানোর হালাল পথও খুলে দিয়েছে। কোন তালাকে কিভাবে স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনা যায়, আর কোথায় পুনরায় বিয়ে লাগবে—এসব বিষয় পরিষ্কার জানা থাকলে অনেক পরিবার ভাঙন থেকে রক্ষা পেতে পারে।
তালাকের পর স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনার শরিয়ত পদ্ধতি
তিন ধরনের তালাক, বিধান এবং স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনার বৈধ উপায় তুলে ধরা হলো—
১. তালাকে রাজয়ি (প্রথম বা দ্বিতীয় তালাক)
এটি এমন তালাক যেখানে ইদ্দত শেষ না হওয়া পর্যন্ত স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয় না। এ অবস্থায় স্বামী চাইলেই ইদ্দতের মধ্যে স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে পারে।
> দুই বৈধ উপায়ে রুজু করা যায়
ক. মৌখিক রুজু: স্বামী বলবে—
> ‘আমি তোমাকে ফিরিয়ে নিলাম।’
> ‘আমি আবার তোমার সঙ্গে সংসার করতে চাই।’ ইত্যাদি স্পষ্ট বাক্য।
খ. কার্যত রুজু: ইদ্দতের সময় সহবাস বা সহবাসের নিয়তে একসঙ্গে থাকা। এক্ষেত্রে নতুন বিয়ে, মেয়ের সম্মতি বা অভিভাবকের অনুমতি—কোনোটিই লাগে না।
২. তালাকে বাইন (হালকা বাইন)
এতে তালাকের সঙ্গে সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। যেমন—
> শর্তযুক্ত তালাক
> খোলার মাধ্যমে তালাক
> কোনো কারণে বাইন তালাক দেওয়া
এক্ষেত্রে স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনতে চাইলে নতুন দেনমোহর নির্ধারণ করে নতুন করে বিয়ে করতে হবে। এটি করা যাবে প্রথম বা দ্বিতীয় তালাকের পর। তৃতীয় তালাক দিলে, আবার বিয়ে করেও ফিরিয়ে নেওয়া যাবে না। এ ক্ষেত্রে নিচের বিধানটি কার্যকর হবে।
৩. তালাকে মুগাল্লাজা (তৃতীয় তালাক/একসঙ্গে ৩ তালাক)
এটি সবচেয়ে কঠোর তালাক। এ অবস্থায়—
> সরাসরি রুজুর কোনো সুযোগ নেই
> প্রথম স্বামী নতুন করে বিয়ে করতে পারে না
> হিল্লা ছাড়া ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়
হিল্লা কী?
স্ত্রী একজন নতুন পুরুষকে স্বাভাবিক ও বৈধ নিয়তে বিয়ে করবে, তার সঙ্গে সংসার করবে। সে স্বামী যদি— তালাক দেয় অথবা মারা যায় তাহলে ইদ্দত শেষে প্রথম স্বামী চাইলে তাকে নতুন বিয়ের মাধ্যমে গ্রহণ করতে পারে। কোনো ধরনের পরিকল্পিত হিল্লা ঘৃণিত ও হারাম।
ইদ্দতের বিধান
ইদ্দতের সময়কাল হলো—
> তিন হায়েজ (যাদের মাসিক হয়)
> তিন মাস (যাদের মাসিক হয় না)
> গর্ভবতী হলে: সন্তান জন্ম পর্যন্ত
কুরআন থেকে দলিল
وَ الۡمُطَلَّقٰتُ یَتَرَبَّصۡنَ بِاَنۡفُسِهِنَّ ثَلٰثَۃَ قُرُوۡٓءٍ ؕ وَ لَا یَحِلُّ لَهُنَّ اَنۡ یَّكۡتُمۡنَ مَا خَلَقَ اللّٰهُ فِیۡۤ اَرۡحَامِهِنَّ اِنۡ كُنَّ یُؤۡمِنَّ بِاللّٰهِ وَ الۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ ؕ وَ بُعُوۡلَتُهُنَّ اَحَقُّ بِرَدِّهِنَّ فِیۡ ذٰلِكَ اِنۡ اَرَادُوۡۤا اِصۡلَاحًا ؕ وَ لَهُنَّ مِثۡلُ الَّذِیۡ عَلَیۡهِنَّ بِالۡمَعۡرُوۡفِ ۪ وَ لِلرِّجَالِ عَلَیۡهِنَّ دَرَجَۃٌ ؕ وَ اللّٰهُ عَزِیۡزٌ حَكِیۡمٌ
‘তালাকপ্রাপ্তা নারীরা তিন মাসিক পর্যন্ত প্রতীক্ষা করবে এবং তাদের পক্ষে জায়েজ নয় সে বস্তু গোপন করা যা তাদের পেটে আল্লাহ সৃজন করেছেন, যদি তারা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে। তাদের স্বামীরা তাদেরকে ওই সময়ের মধ্যে পুনঃগ্রহণে অধিক হকদার, যদি তারা আপস-নিষ্পত্তি করতে চায় এবং পুরুষদের ওপর নারীদের যেমন হক আছে, তেমনই নারীদের ওপরও পুরুষদের হক আছে। অবশ্য নারীদের ওপর পুরুষদের বিশেষ মর্যাদা আছে এবং আল্লাহ মহাপরাক্রান্ত, প্রজ্ঞাশীল।’ (সুরা আল-বাকারা: আয়াত ২২৮)
وَ الّٰٓیِٴۡ یَئِسۡنَ مِنَ الۡمَحِیۡضِ مِنۡ نِّسَآئِكُمۡ اِنِ ارۡتَبۡتُمۡ فَعِدَّتُهُنَّ ثَلٰثَۃُ اَشۡهُرٍ ۙ وَّ الّٰٓیِٴۡ لَمۡ یَحِضۡنَ ؕ وَ اُولَاتُ الۡاَحۡمَالِ اَجَلُهُنَّ اَنۡ یَّضَعۡنَ حَمۡلَهُنَّ ؕ وَ مَنۡ یَّتَّقِ اللّٰهَ یَجۡعَلۡ لَّهٗ مِنۡ اَمۡرِهٖ یُسۡرًا
‘তোমাদের যেসব স্ত্রীরা মাসিক ঋতু আসার বয়স অতিক্রম করেছে তাদের (‘ইদ্দতের) ব্যাপারে যদি তোমাদের সন্দেহ সৃষ্টি হয়, সেক্ষেত্রে তাদের ‘ইদ্দাতকাল তিন মাস, আর যারা (অল্প বয়স্কা হওয়ার কারণে) এখনও ঋতুবর্তী হয়নি (এ নিয়ম) তাদের জন্যও। আর গর্ভবতী স্ত্রীদের ‘ইদ্দতকাল তাদের সন্তান প্রসব পর্যন্ত। যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার কাজ সহজ করে দেন।’ (সুরা আত-ত্বলাক: আয়াত ৪)
হাদিস থেকে দলিল
হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত যে—
أَنَّ رَجُلاً طَلَّقَ امْرَأَتَه“ ثَلاَثًا فَتَزَوَّجَتْ فَطَلَّقَ فَسُئِلَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم أَتَحِلُّ لِلأَوَّلِ قَالَ لاَ حَتّٰى يَذُوقَ عُسَيْلَتَهَا كَمَا ذَاقَ الأَوَّلُ
এক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে তিন তালাক দিলে সে স্ত্রী অন্যত্র বিয়ে করল। পরে দ্বিতীয় স্বামীও তাকে তালাক দিল। নবীজিকে (সা.) জিজ্ঞাসা করা হলো মহিলাটি কি প্রথম স্বামীর জন্য হালাল হবে? তিনি বললেন— না, যতক্ষণ না সে দ্বিতীয় স্বামী তার স্বাদ গ্রহণ করবে, যেমন স্বাদ গ্রহণ করেছিল প্রথম স্বামী। (বুখারি ৫২৬১),
হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রিফা’আ কুরাযীর স্ত্রী রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এসে বললেন—
يَا رَسُوْلَ اللهِ إِنَّ رِفَاعَةَ طَلَّقَنِي فَبَتَّ طَلاَقِي وَإِنِّي نَكَحْتُ بَعْدَه“ عَبْدَ الرَّحْمٰنِ بْنَ الزُّبَيْرِ الْقُرَظِيَّ وَإِنَّمَا مَعَه“ مِثْلُ الْهُدْبَةِ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم لَعَلَّكِ تُرِيدِينَ أَنْ تَرْجِعِي إِلٰى رِفَاعَةَ لاَ حَتّٰى يَذُوقَ عُسَيْلَتَكِ وَتَذُوقِي عُسَيْلَتَهُ
হে আল্লাহর রাসুল! রিফা’আ আমাকে পূর্ণ সম্পর্কচ্ছেদের তালাক তিন তালাক দিয়েছে। পরে আমি আবদুর রহমান ইবন যুবায়র কুরাযীকে বিয়ে করি। কিন্তু তার কাছে আছে কাপড়ের পুঁটলির মতো একটি জিনিস। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, সম্ভবত তুমি রিফা’আর কাছে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছ। কিন্তু তা তো সম্ভব নয়, যতক্ষণ না সে অর্থাৎ (দ্বিতীয় স্বামী) তোমার স্বাদ গ্রহণ করে এবং তুমি তার স্বাদ গ্রহণ কর।’ (বুখারি ৫২৬০)
ভেঙে যাওয়া সম্পর্কের ধ্বংসস্তূপের মাঝে কখনো আবার গজিয়ে ওঠে ভালোবাসার কোমল অঙ্কুর। ইসলাম কখনো পরিবারের ভাঙন চায় না; বরং ফেরার পথ খুলে দেয়, ক্ষমার দুয়ার খুলে দেয়, শান্তির দরজা খুলে দেয়। যে স্বামী–স্ত্রী ভুলে, রাগে, আবেগে তালাক পর্যন্ত পৌঁছে গেছেন—তারা যদি আন্তরিকভাবে নিজেদের ভুল বুঝতে পারেন, আল্লাহর কাছে ক্ষমা চান এবং শরিয়তের বিধান মেনে আবার নতুন করে জীবন শুরু করেন—তাহলে সেই সংসার আগের চেয়ে আরও মজবুত ও শান্তিময় হয়।
তথ্যসূত্র: সুরা বাকারা: আয়াত ২২৮, সুরা তালাক্ব: আয়াত ৪, বুখারি ৫২৬০-৫২৬১, ফাতাওয়া আলমগিরি: ১/৩৭৩



